আজ পরিকল্পনা মাফিক সকাল 6 টায় উঠে পড়লাম । 20 মিনিটের মধ্যে তৈরী হয়ে নিয়ে পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে পড়লাম জঙ্গলের মধ্যে । আকাশে আসতে আসতে আলো ফুটছে। কটেজ থেকে কিছুটা নেমে গিয়ে জঙ্গলের পথ। আজ আমাদের এই পথে সঙ্গী হিসেবে কটেজের একজন ছিল ,জঙ্গলের মধ্যে যাতে হারিয়ে না যাই। ছেলেটির নাম সুশান্ত নায়েক । স্থানীয় আদিবাসী ছেলে, বয়স 17/18 হবে। হাতে একটা ডান্ডা নিয়ে আমাদের পথ দেখাতে দেখাতে আগে চললো । আলো আঁধারি পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে গাছের পাতার ওপর টপ টপ করে শিশিরের জলের শব্দ শুনতে পেলাম । গোটা রাস্তাটার প্রায় সবটাই স্যত্সাতে হয়ে আছে । নিস্তব্ধ জঙ্গলের বুক চিরে হাটার সময় টুপ টাপ শব্দ শোনা ( পাতার ওপর জল পরার শব্দ) এক কথায় অসাধারণ । পাবলো প্রথম বার শিশিরের জলে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে– বিষয় টা কি? জঙ্গলের মধ্যে থেকে নানা ধরনের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, যদিও খুব বেশি কিছু এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি। যেতে যেতে একটা বাঁকে হঠাৎ করে একটা spider web চোখে পড়ল । বেশ কিছু পরজীবী বড় বড় গাছ গুলকে জড়িয়ে ধরে উপরে উঠে গেছে । কিছু অর্কীড চোখে পড়ল । মাঝে মাঝে উই পোকার বিশাল বিশাল ঢিপি । এর মধ্যেই আমরা বেশ কিছু ছবি তুললাম। যে সমস্ত গাছ গাছালিতে চারদিক ভরে আছে তার কিছু নাম পড়াশোনা করে উদ্ধার করলাম। যেমন Kalicha, Belo, Kumbhi, Karanja , Sal, Treak and Sidha. কিছু ফুল গাছ যেমন ইন্দ্রজবা, পতালগারুদা, আকন্দ চোখে পড়ল । এইসব দেখতে দেখতে প্রায় 4 কিমি রাস্তা কখন যে হেটে ফেলেছি সেটা সূর্য মামার তেজ দেখে বুঝতে পারলাম । জঙ্গলের মধ্যে এতটা সময় নিয়ে এইভাবে ঘুরে বেড়ানো আমার কাছে এই প্রথম । পায়ে হেঁটে যে কোনো জঙ্গলে সবসময় ঘোরা সম্ভব হয় না । কিন্তু চন্দাকা ফরেস্ট এ এই আনন্দটা সবার সাথে ভাগ করে নিলাম। কোনএরপর কটেজ এ ফিরে ব্রেকফাস্ট সেরে নন্দনকানন যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। নন্দনকানন মাত্র 26 কিমি আমাদের এই ন্যাচার ক্যাম্প থেকে । চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। যারা পুরী বা ভুবনেশ্বর আসে তারা সবাই মোটামুটি ভাবে নন্দনকানন ঘুরতে আসে। এর আগে আমি একবার বছর 12 আগে ঘুরে গেছি। এবার পাবলোর জন্যই মুলত আসা। কিন্তু কেন নাম টা নন্দনকানন হোলো এটা নিয়ে এর আগে ভাবিনি। আসলে কানন বললেই আমরা কলকাতার কানন কেই চিনি। হাঁ, আমি দিদির কানন থুড়ি দাদার কানন এর কথা বলছি। তবে এই কানন সেই কানন নয়। 1967 চন্দাকা ফরেস্ট এ যে বাঘিনী টিকে শেষবার দেখা গিয়েছিল তাকেই এখানে আনা হয়। 1978 পর্যন্ত সেই বাঘিনী টি বেঁচে ছিল। তার থেকেই এই নন্দনকানন নাম করন । পরে অবশ্য নন্দন নামেও একটি বাঘ এখানে ছিল। যাইহোক বেশ কিছুটা সময় এইখানে কাটিয়ে ফেললাম । করোনার জন্য সবকটি সাফারি পার্ক বন্ধ আছে । কাজেই এটা শুনে পাবলো কিছুটা হতাশ হোলো । তবে সাদা বাঘ থেকে লেপার্ড, হাতি থেকে কুমির, সিংহ থেকে পাখি এইসব দেখে পাবলো কিছুটা হলেও আনন্দ পেল। 3 টে নাগাদ OTDC রেস্ট্রুরেন্ট দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা কটেজের উদ্দেশে রওনা দিলাম। মাঝে একবার গাড়ি দাড় করিয়ে রাস্তার একটি দোকানে চা খেলাম। হাল্কা ঠান্ডা আমেজে আদা দিয়ে চা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম। আমি অবশ্য এক গ্লাস খেয়ে আর এক গ্লাসের অর্ডার দিলাম। চা শেষ করে আবার ডেরার ড্যাম এ গিয়ে দড়ালাম। সূর্যাস্ত পর্যন্ত বেশ কিছুটা সময় ড্যামের ওপর দিয়ে হেটে বেড়ালাম ।এই অনুভূতি ভাষায় সবটা বোঝানো যাবে না এবং আমি সেই চেষ্টাও করবো না। এবার প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে ।সামনের জলার ধারে গোটা কয়েক পেলিকানদের দেখা মিলল। আমরা গাড়িতে উঠে কটেজের দিকে রওনা দিলাম। কিছুটা যাওয়ার পর কলকাতা থেকে আগত একটি ফ্যামিলির সাথে রাস্তাতেই আলাপ হোলো । কটেজে পৌছে এবার গোছগাছ করার পালা । আগামীকাল সকালেই বেরোতে হবে ভিতরকণিকার উদ্দেশ্যে । কিছুটা সময় ছাদে উঠে গল্প করে কাটিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পালা । এর মধ্যেই কটেজের কর্মীদের সাথে নিয়ে ছবি তুললাম। প্রতিটি মানুষ ই খুব ভালো ও মিশুকে । পরের দিন সকালে সাড়ে সাত টায় বেরোতে হবে । তাই আর দেরী না করে শুয়ে পড়লাম ।
চলবে.. …