দ্বিতীয় কিস্তি:
আজ বেশ সকালেই ঘুম ভেঙ্গে গেল । বেশ ঠান্ডা আমেজ। 8 টায় জঙ্গল ঘুরতে বেরোনো । সবাই মিলে তৈরী হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিল এ গেলাম। আমাদের কটেজ থেকে 100 মিটার দুরে। চারিদিকে একটা জঙলী আবহাওয়া। পাখির কিচির মিচির শব্দে বেশ একটা ভালোলাগা ছন্দ । নানা রকমের ফুলের গন্ধ । বাতাসের একটা মিষ্টি বয়ে চলা । আমরা পুরি সব্জি ও উকমা খেলাম। সঙ্গে চা। প্রায় 8টা 10 নাগাদ আমাদের জিপ এলো। 8 সীটের গাড়িতে আমরা 3 জন। গায়ে একটা জ্যাকেট চাপিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। এইবার প্রকিতির সৌন্দর্য উপভোগ করার পালা । এইবারের জঙ্গলে আমি কোনো প্রাণী ও জীবজন্তু দেখতে আসি নি। নেহাত ই ন্যাচার কে মনবন্ধ করতে এসেছি। লাল মাটির মেঠো পথ ধরে আমাদের জিপ চলতে শুরু করলো। মহুয়া, পলাশ, শালের বনকে দুধারে রেখে হাওয়া খেতে খেতে এগুতে লাগলাম। অনেকটা আমাদের বাঁকুড়া/ পুরুলিয়া/ বীরভূম এর মতো ।
কিছুটা যাবার পর কয়েকটা জঙ্গল ফওয়্ল এর দেখা পেলাম। এক ঘন্টা গাড়ী চলার পর আমরা একটা ওয়াচ টাওয়ার এর সামনে দড়ালাম। বিভিন্ন পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে । হঠাৎ করে ময়ূরের ডাক শুনলাম। কিছু লঙ্গুর এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে পড়ল।
চন্দাকা ডাম্পরা সংচুয়ারী জায়গাটা শেষ 20 বছরে তার আয়তন বাড়িয়েছে। এখন প্রায় 193 বর্গ স্কোয়ার কিমি হয়েছে। এর মধ্যেই আমাদের সামনে কয়েকটি ময়ূর হাজির। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমরা ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করলাম।
একটা crested serpent ঈগল মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে দুরের একটা গাছে বসলো ।এর পর গেলাম কুমারকুন্তী reservoir এ। কিছু pintail ও কয়েকটা ব্রাহ্মণী Duck দেখলাম ।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বিশাল ওয়াচ টাওয়ার এর উপরে উঠলাম। সেখান থেকে কয়েকটা white breasted waterhern কে দেখা গেলো । অনেকটা সময় এইখানে কাটিয়ে আমরা আবার গাড়িতে চাপলাম । শাল, মহুয়া , পলাশ এ জঙ্গলে বেশ কিছু অর্কীড দেখতে পেলাম । ফেরার পথে ড্রাইভার আমাদের বেশ কয়েকটা ভাঙ্গা রাজবাড়ির ধংসাবসেশ দেখাল । আর একটা জিনিস দেখলাম যেটা না বললেই নয় । গুড় আর নুন মাটি দিয়ে মেখে রাখা , যেটা হাতি ও হরিণের খাবার জন্য ব্যবহার করা হয় ।
জঙ্গলের মধ্যে ঘোরার সময় লোকাল আদিবাসী দের জন্য তৈরী একটা প্রথমিক স্কুল দেখলাম । এখনকার মানুষ জন যে এই রকম জায়গাতেও আসতে আসতে পড়াশোনাটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে এটা দেখে একটা ভাল লাগল।এরপর ফেরার সময় ডাম্পরা ফরেস্ট এর অন্য গেট দিয়ে বেরুবার সময় দেখা হলো নন্দ ও যশোধার সাথে। এরা দুজনেই এখানের স্থায়ী বাসিন্দা। বেশ কয়েক বছর আগে জঙ্গল থেকে এদের ধরে এনে পোষ মানানো হয়েছে । দুজনেই এই কোভিড কালে বেশ দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে । এদের সাথে দুরত্ব বজায় রেখে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা আমাদের কটেজ এ ফিরে এলাম ।
এবার দুপুরের খাওয়া দাওয়া । তবে কাল রাতে খাবারের স্বাদ নিয়ে যে আশংকা ছিল আজ দুপুরে তা আর ছিল না ।
ভাত, অরহর ডাল, আলুভাজা, পাঁচ মিসলি তরকারি, ডিমের ঝোল, পাঁপড়, স্যলড আর শেষ পাতে একটা রসগোল্লা। বাঙ্গালী আর রসগোল্লা দুজন দুজনের পরিপূরক, তা সে ছোট বেলায় পরীক্ষার খাতায় হোক বা বড়ো বেলায় বাংলার বাইরে কোনো জায়গা হোক ।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা ঠিক করলাম লোকাল ড্যাম গুলো দেখতে যাবো । নিজেদের গাড়ি নিয়ে 3টে 40 নাগাদ বেড়িয়ে পড়লাম। পথ দেখানোর জন্য কটেজ এর একজন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হোলো । প্রথমে আমরা ঝুমকা ড্যাম এ গেলাম। আধা ঘন্টা কাটিয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম। তারপর এলাম ডেরা ড্যাম্প এ। অনেক্ষন ধরে sun set দেখে সন্ধ্যা বেলায় কটেজ এ ফিরে এলাম। এতক্ষণে বেশ একটা ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে । কটেজ এ ঢুকে গা হাত পা ধুয়ে সোজা ছাদে । কেয়ার টেকার কে বললাম ভেজিটেবল পকোড়া ও চা দিতে।
এখন প্রায় রাত 8টা । বাঁশ গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে পূর্ণিমার গোটা চাঁদ। অনেক দুর থেকে মাঝে মাঝে কিছু পাখির ডাক । কয়েক টা কুকুরের ডাক অনেক দুর থেকে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে । অনেকদিন পর টিকটিকির ডাক শুনতে পেলাম। অনবরত ঝি ঝি পোকার ডাক । এক অদ্ভূৎ নি:শব্দ চারিদিকে। এর মধ্যে সোনালী মুঠো ফোন দেখছে আর পাবলো ছাদে পায়চরি করছে। হঠাৎ করে সোনালী বলল আগামীকাল নন্দন কানন টা একবার ঘুরে এলে কেমন হয়? আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। কারন আগামী কাল আমাদের এখনো পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না । চন্দাকা থেকে নন্দনকানন মাত্র 26km । কাজেই আগামী কাল এর পরিকল্পনা ফাইনাল। ঠিক করলাম সকালে ঘুম থেকে উঠে পায়ে হেঁটে ন্যাচার ক্যাম্পের আশেপাশে জায়গাটা ঘুরে নিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নন্দন কানন যাবো । আসতে আসতে রাত বাড়তে লাগল। আমরাও এটা সেটা নানা ধরনের গল্পে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। 3/ 4 ঘন্টা চাঁদের আলোয় গল্প করে এইভাবেই কেটে গেল। এবার রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ার পালা । একটা কথা না বললেই নয় যে এই ধরনের প্রকিতির মাঝে নিজেদের মতো করে কিছুটা হলেও সময় কাটাতে চাইলে টিভি চ্যানেল থেকে দুরে থাকাটা খুব জরুরি ।
চলতে থাকবে।